দাদু ও আমি

গতবার পৌষমাসে বড়দিনের ছুটিতে গ্রাম এর বাড়ি গুপ্তিপাড়ায় বেড়াতে গেছি | পৌষ মাসের কনকনে ঠান্ডা শেষ রাতে টিনের চলে টুপটাপ করে শিশির পড়ছে গাছ থেকে | সকালই ঘুম থেকে উঠে দেখি চারদিক কুয়াশায় ঢাকা,কিছুই দেখা যাচ্ছে না | আমি সোয়েটারের ওপর একটা চাদর মুড়ি দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম | কাছেই বড়ো মাঠ, ঘাসের বুকে শিশির জমেছে | সজনে গাছ থেকে দু একটা ফুল পড়ছে | গাছের ডালে পাখিরা কিচিরমিচির করছে | চলতে চলতে একটা টালির ছাউনি দেওয়া বাড়ির সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম | কি সুন্দর গাঁদা ফুল সার উঠোনে জুড়ে | হলুদ গাঁদা,লাল গাঁদা,তার সাথে ডালিয়া,চন্দ্রমল্লিকা,জবা কতরকমের ফুল দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় | আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার বয়সী একটি ছেলে এসে বলল “কি দেখছো ফুল? নেবে দুটো?” | আমি বললাম “না,গাছেই ওকে ভালো লাগছে | খুব সুন্দর,নিজেরা করেছো বুঝি? | ছেলেটি মাথা নেড়ে বলল “হ্যাঁ” | বললাম “তোমার নাম কি?” সে বললে “আমার নাম কালু,তুমি কোথায় থাকো?” আমি বললাম “ওই মাঠের ধরে ধরে আমাদের বাড়ি,কিন্তু আমি এখানে থাকি না,বেড়াতে এসেছি পিসিদের কাছে”কুয়াশা একটু কমেছে ঠিকই কিন্তু রোদ তেমন ওঠেনি | শিশিরে পা ভিজে | হিমেল হয়ে পা দুটো ঠান্ডা কনকন করছে | হঠাৎ দূরে দেখি খুব পুরানো একটা বাড়ি | চারিদিক খাঁখাঁ করছে | সামনে উইঢিবি দু একটা বুনো গাছ | একটা পুকুর,জলটা নীলচে | পুকুরে অনেক শালুক ফুটে আছে | হাঁসগুলো সাঁতার কাটছে | ঘটে মেয়েরা বাসন মাজছে | কেউ টুপটুপ করে ডুব দিয়ে স্নান করে একছুটে বাড়ির পথ ধরছে | পা পা করে আমি ওই পুরানো বাড়িটার দিকে এগোচ্ছি, কি আছে ওখানে দেখার জন্য | বরাবর সিঁড়ি ভাঙ্গা | সেই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দেখি বিশাল ঘর, জানলা দরজা কোনো তাই র আস্ত নেই | আমার সাড়া পেয়ে কয়েকটা পায়রা একসাথে বকবকম করে আমাকে স্বাগত জানালো | আর একটা ঘরে পা দিতেই হুড়মুড় করে কি যেন পড়লো | চমকে উঠলাম!! | বুকটা দুরুদুরু করছিলো ঠিকই, কিন্তু ভয় তেমন পাইনি  |  পাশ ফায়ার দেখি একটা বিড়াল, ওপাশে বড়ো ঠাকুর দালান, কোনো বিগ্রহ নেই | একটু ভিতরে গিয়ে দেখি একজন খুব বুড়ো মানুষ রোদ পোহাচ্ছে | কাছে গিয়ে বলি ” ও দাদু, কি করছো? এই বাড়ি তোমাদের?” | আমার কথা শুনে ছানি পড়া চোখে হাত আড়াল করে দেখার চেষ্টাই বললো “কে তুমি? চিনতে পারলাম না!! ” বললাম “আমি এখানে থাকি না, কিন্তু তুমি ছেঁড়া জামা পরে আছো, শীত করছে না? |”

4914478820_984e05149d_o-1024x768

বুড়ো দাদু ছলছল চোখে বললো “শীত তো করে বাবা, কিন্তু পাবো কোথায়? কে দেবে সোয়েটার,চাদর? পেটের ভাত জোটে না, আমার কেউ নেই বাবা | এই বাড়ি আমার নয়, ঘর খানায় পরে থাকি, কোনো রকমে চলে |” দেখে আমার খুব কষ্ট হলো | বললাম “আমার এই চাদর টা নাও,গায়ে দিও|” চাদর তা তার গায়ে জড়িয়ে দিতেই দেখলাম তার চোখে জল | বলি “দাদু তুমি কাঁদছো?” বুড়ো মানুষটা তার শীর্ণ হাতখানা আমার মাথায় দিয়ে বললো “বেঁচে থাকো দাদুভাই | বড়ো হও, সবাইকে ভালোবেসো | ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন |”

বেলা বেশ বেড়ে গেছে দেখে বাড়ি ফিরে এলাম | আমাকে দেখেই মায়ের চিৎকার “কিরে,সেই সকালে বেরিয়ে এখন ফিরলি? আর তোর চাদরখানা কোথায়? ভয় পেয়ে বলি “মা,ওটা একটা বুড়ো দাদু কে দিয়েছি শীতে খুব কষ্ট পাচ্ছে |”

“দাঁড়াও!! কষ্ট পাওয়াচ্ছি” বলেই পিঠে ঘা কতক দিতেই পিসি ছুতে এসে বলে “কি হলো? মারছো কেন ছেলেটাকে?” মা বলতে থাকে “দাতা কর্ণ হয়েছে, চাদরখানা দান করে এসেছে, নিজে উপায় করে দান কর,তখন কেউ কিছু বলবে না |”

পিসি বললো “ভালোই করেছে | মনটা সব সময় বড়ো করতে হয় নাহলে মানুষ কে চেনা যায়না | মানুষের কষ্ট যদি না বোঝে তবে আর মানুষ কিসে | আয় বাবা খাবি আয় | অনেক বেলা হলো |” পিসির হস্তক্ষেপে সে যাত্রায় আমি রক্ষা পাই |

Avatar

Sabyasachi Banerjee

With a degree in Computer Science from WBUT he worked as a Freelance Social media Manager and that is when he realized his passion for writing and blogging and then shifted to full time blogging.

More Posts

Related posts

4 Thoughts to “দাদু ও আমি”

  1. Avatar Reshmi Das

    Bah! Nicely Written.

    1. Avatar Sabyasachi Banerjee

      Thank You Reshmi 🙂

  2. Avatar Nandita Mitra

    Emon manusher dorkar ajker somaje

    1. Avatar Sabyasachi Banerjee

      Ekdm, emon manus er khub dorkr

Leave a Comment